**টেকসই উন্নয়ন** (Sustainable Development) হলো এমন একটি উন্নয়ন প্রক্রিয়া যা বর্তমানের চাহিদা পূরণ করে, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চাহিদা মেটানোর সক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত না করে। এটি অর্থনীতি, সমাজ এবং পরিবেশের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে দীর্ঘমেয়াদি সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করে।
---
### টেকসই উন্নয়নের মূল ধারণা:
১. **অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা:**
- অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা এবং দারিদ্র্য বিমোচন।
- সবার জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি।
২. **সামাজিক ন্যায়বিচার:**
- সমতা ও অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা।
- স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নিরাপত্তা ও মানবাধিকার সংরক্ষণ।
৩. **পরিবেশ সংরক্ষণ:**
- প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারে ভারসাম্য রক্ষা।
- জীববৈচিত্র্য রক্ষা এবং পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধ।
- নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি।
---
### টেকসই উন্নয়নের তিনটি স্তম্ভ:
১. **অর্থনীতি:**
- উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থা, এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে প্রবৃদ্ধি অর্জন।
২. **সমাজ:**
- সামাজিক অন্তর্ভুক্তি ও সমতা প্রতিষ্ঠা।
- শিক্ষার প্রসার, স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়ন, এবং নারীর ক্ষমতায়ন।
৩. **পরিবেশ:**
- পরিবেশ দূষণ কমানো এবং প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের দক্ষতা বৃদ্ধি।
- জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা এবং পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি উৎস ব্যবহার।
---
### জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (SDGs):
২০১৫ সালে জাতিসংঘ ২০৩০ সালের মধ্যে অর্জনের জন্য **১৭টি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য** (Sustainable Development Goals - SDGs) নির্ধারণ করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য লক্ষ্যগুলো হলো:
1. দারিদ্র্য বিমোচন।
2. ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী।
3. স্বাস্থ্য ও কল্যাণ।
4. মানসম্মত শিক্ষা।
5. লিঙ্গসমতা।
6. নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন।
7. সাশ্রয়ী ও পরিষ্কার জ্বালানি।
8. অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কাজের সুযোগ।
9. টেকসই অবকাঠামো ও শিল্পায়ন।
10. বৈষম্য কমানো।
11. টেকসই শহর ও গ্রামীণ উন্নয়ন।
12. দায়িত্বশীল ভোগ ও উৎপাদন।
13. জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা।
14. সামুদ্রিক সম্পদ সংরক্ষণ।
15. স্থলজীবন রক্ষা।
16. শান্তিপূর্ণ সমাজ ও সুশাসন।
17. লক্ষ্য অর্জনের জন্য বৈশ্বিক অংশীদারিত্ব।
---
### বাংলাদেশে টেকসই উন্নয়নের গুরুত্ব:
বাংলাদেশ একটি জনবহুল ও উন্নয়নশীল দেশ। এখানকার অর্থনীতি, পরিবেশ ও সামাজিক কাঠামোতে ভারসাম্য আনতে টেকসই উন্নয়ন অপরিহার্য। দারিদ্র্য দূরীকরণ, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা, এবং নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের পথে অগ্রসর হওয়া সম্ভব।
---
### চ্যালেঞ্জ:
- জনসংখ্যার চাপ।
- জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি।
- অবকাঠামোগত দুর্বলতা।
- শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সীমাবদ্ধতা।
- প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি।
---
**সুতরাং, টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য সমন্বিত নীতি, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অপরিহার্য।**
বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়নের পথে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এসব প্রতিবন্ধকতা দূর করার মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা সম্ভব। প্রধান প্রতিবন্ধকতাগুলো হলো:
### ১. **পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ**
- **জলবায়ু পরিবর্তন**: বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা অন্যতম দেশ। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙন এবং লবণাক্ততার কারণে কৃষি, জীবিকা ও অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
- **দূষণ**: বায়ু, পানি এবং ভূমি দূষণ ক্রমবর্ধমান সমস্যায় পরিণত হয়েছে। শিল্পকারখানার বর্জ্য এবং অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ণ এই সমস্যা আরও বাড়াচ্ছে।
### ২. **অপর্যাপ্ত অবকাঠামো**
- সড়ক, রেলপথ এবং বিদ্যুৎ সরবরাহের মতো অবকাঠামো উন্নয়নে ঘাটতি রয়েছে। এটি ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগে বাধা সৃষ্টি করে।
- নগরায়ণের চাপের কারণে শহরগুলোর আবাসন ও পরিবহন সমস্যা প্রকট হচ্ছে।
### ৩. **দারিদ্র্য ও বৈষম্য**
- বাংলাদেশে এখনও একটি উল্লেখযোগ্য জনগোষ্ঠী দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে।
- গ্রামীণ ও শহরের মধ্যে এবং সামাজিক শ্রেণির মধ্যে আয়ের বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে।
### ৪. **শিক্ষা ও দক্ষতার ঘাটতি**
- মানসম্মত শিক্ষার অভাব এবং কারিগরি দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে।
- জনসংখ্যার একটি বড় অংশ প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও জ্ঞানের অভাবে কর্মসংস্থান থেকে পিছিয়ে পড়ছে।
### ৫. **প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা**
- দুর্নীতি, জবাবদিহিতার অভাব এবং প্রশাসনিক অদক্ষতা উন্নয়ন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করছে।
- নীতিমালার সঠিক বাস্তবায়নে ঘাটতি রয়েছে।
### ৬. **অধিক জনসংখ্যার চাপ**
- বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম জনবহুল দেশ, যা জমি, পানি, খাদ্য এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের উপর চাপ সৃষ্টি করছে।
- শহরগুলোতে অতিরিক্ত জনসংখ্যার কারণে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং অন্যান্য নাগরিক সেবা ব্যাহত হচ্ছে।
### ৭. **কৃষিখাতে চ্যালেঞ্জ**
- কৃষির উপর নির্ভরশীল একটি বড় জনগোষ্ঠী প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার কারণে উৎপাদনশীলতায় পিছিয়ে আছে।
- জমির অবক্ষয় এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে কৃষি উৎপাদনে ধস নামছে।
### ৮. **অপ্রতুল প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন**
- প্রযুক্তি খাতে গবেষণা ও উদ্ভাবনে পিছিয়ে থাকার কারণে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে।
### ৯. **নিরাপদ জ্বালানি ও নবায়নযোগ্য শক্তির অভাব**
- এখনও অধিকাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভরশীল, যা টেকসই উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে।
### করণীয়:
- পরিবেশবান্ধব নীতি প্রণয়ন এবং কার্যকর বাস্তবায়ন।
- শিক্ষা ও কারিগরি দক্ষতার উন্নয়ন।
- দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ।
- নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি এবং পরিবেশ সংরক্ষণে বিনিয়োগ।
- গ্রামীণ উন্নয়ন ও আঞ্চলিক বৈষম্য হ্রাসে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ।
সঠিক পরিকল্পনা ও কার্যকর উদ্যোগের মাধ্যমে এই প্রতিবন্ধকতাগুলো অতিক্রম করে টেকসই উন্নয়ন অর্জন করা সম্ভব।
No comments:
Post a Comment